বড়দের বাংলা কবিতা,ছোটদের বাংলা কবিতা,বড়দের বাংলা গল্প,ছোটদের বাংলা গল্প এবং বাংলা উপন্যাস এর প্লাটফর্ম।বাংলা সাহিত্যের সকল বিখ্যাত কবি,লেখকদের পাশাপাশি আমাদের নিজস্ব লেখা কবিতা এবং গল্প এই ওয়েবসাইটে পেয়ে যাবেন।

Breaking

শনিবার, ৩০ মে, ২০২০

মে ৩০, ২০২০

দেশপ্রেম-নিজস্ব কবিতা

দেশপ্রেম

সাহেমিরাজ মল্লিক



ভারত আমার সোনার দেশ 
এমন দেশ কোথাই খুঁজে পাবে নাকো
বিশ্বসেরা ভারত আমার 
এখানেই জন্ম ,এখানেই মৃত্যু আমার।
আজকে আমি দেশদ্রোহী
পঞ্চবার দিনে এ ভুমি চুম্বনের ও'পরে।
এ মাটি করি পুজো আমি
তা ও আমাকে শুনতে হয় দেশদ্রোহী তুমি..
ধর্মের আধারে নয়গো এ ভারত আমার
এ যে সব ধর্মের ও'পরে।
ধর্ম তোমাকে নাইকো শেখায়
অন্য ধর্ম করতে ঘৃণা 
করছে তোমার ব্রেনওয়াশ
অন্ধ ভক্তরা ধর্মের নামে।
উপায় নেই ওদের কাছে
ধর্মের নাম বাদ দিলে
পড়বে ফাঁস ওদের গলায়
দেশবাসীর ও সামনে।
এ বার তুমি খুলে চোখটা 
দেখো বিপদ এ আছে ভারতমাতা
করবো না আর ধর্মের লড়াই
এ বার আমাদের অধিকার চায়,
চলবে লড়াই এ বার
খাদ্য বাসস্থানের ও'পরে।



মে ৩০, ২০২০

পুরুষ মানুষ -নিজস্ব কবিতা


পুরুষ মানুষ




সবাই বলে পুরুষ তুই

চোখে জল মানায় না কী?

সমাজ বলে মরদ তুই

তোদের আবার কষ্টটা কী!!




বলি কাকিমা মানুষ আমরা

মাটির পুতুল নয়

পরে গেলে ব্যাথা হয়

লোহার শরীর নয়।




অল্প বয়সেই চিন্তা আসে

বাবার আয়ের প্রতি

বড় বয়সে চিন্তার কারণ 

সন্তান সন্ততি।




তোমরা ভাবো শক্ত যদিও

মনটা খুবই নরম

কষ্ট আমাদের ও হয়

শুধু করিনা প্রদর্শন।




দিনশেষে ঘর্মাক্ত শরীর

কষ্ট নিয়ে বুকে

আমরাও খুঁজি একটি কাঁধ

কাঁদবো মাথা রেখে।






বুধবার, ১৩ মে, ২০২০

মে ১৩, ২০২০

অনন্ত প্রেম - রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর


ভূমিকা 

বাঙালী কবিতা প্রেমিকদের আবেগ হল রবীন্দ্রনাথ, একধারে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর অনন্ত প্রেমের কবিতা ছাড়াও লিখেছেন বিভিন্ন ধরণের কবিতা।
 অনন্ত প্রেম কবিতাটি রবি ঠাকুর নিজের যৌবন থেকে শেষ জীবন পর্যন্ত নিজের ভালোলাগা বা ভালোবাসার  প্রতিটি মুহুর্তকে তুলে ধরেছেন। তিনি খুব সম্ভত প্রথম যেই বালিকার প্রেমে পরেছিলেন তার কথা ও প্রেমের আত্মনিবেদন প্রকাশ পায় এই কবিতাতে।

অনন্ত প্রেম

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর 


তোমারেই যেন ভালোবাসিয়াছি শত রূপে শতবার
জনমে জনমে যুগে যুগে অনিবার।
চিরকাল ধরে মুগ্ধ হৃদয় গাঁথিয়াছে গীতহার–
কত রূপ ধরে পরেছ গলায়, নিয়েছ সে উপহার
জনমে জনমে যুগে যুগে অনিবার।


যত শুনি সেই অতীত কাহিনী, প্রাচীন প্রেমের ব্যথা,
অতি পুরাতন বিরহমিলন কথা,
অসীম অতীতে চাহিতে চাহিতে দেখা দেয় অবশেষে
কালের তিমিররজনী ভেদিয়া তোমারি মুরতি এসে
চিরস্মৃতিময়ী ধ্রুবতারকার বেশে।


আমরা দুজনে ভাসিয়া এসেছি যুগলপ্রেমের স্রোতে
অনাদি কালের হৃদয়-উৎস হতে।
আমরা দুজনে করিয়াছি খেলা কোটি প্রেমিকের মাঝে
বিরহবিধুর নয়নসলিলে, মিলনমধুর লাজে–
পুরাতন প্রেম নিত্যনূতন সাজে।


আজি সেই চির-দিবসের প্রেম অবসান লভিয়াছে,
রাশি রাশি হয়ে তোমার পায়ের কাছে।
নিখিলের সুখ, নিখিলের দুখ, নিখিল প্রাণের প্রীতি,
একটি প্রেমের মাঝারে মিশেছে সকল প্রেমের স্মৃতি–
সকল কালের সকল কবির গীতি।



অনন্ত প্রেম কবিতার ভাব সারমর্ম

এই কবিতাটি মানসী নামক কাব্যগ্রন্থ থেকে নেওয়া হয়েছে।কবিতাটির সারমর্ম যাবার আগে একটু জেনে নিই কবিতাটি কোন পটভূমিতে লেখা হয়েছিল।

বাল্যকাল থেকে পশ্চিম ভারত রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কাছে রোমান্টিক কল্পনার বিষয় ছিল।এখানে তিনি বিদেশের সাথে এদেশের সংযোগস্থল বলে মনে করতেন।মানসী তে উল্লেখিত কথা অনুযায়ী বহু শতাব্দী ধরে এখানেই ইতিহাসের বিপুল পটভূমিকাই বহু সাম্রাজ্যের উত্থান-পতন এবং নব নব ঐশ্বর্যের বিকাশ ঘটে।প্রকৃতির বিচিত্র রূপ আর বর্ণের ছবির ধারা অঙ্কিত করে চলেছে বলে তার ধারণা। এই সময় তিনি পাড়ি দেন গাজীপুরে।গাজীপুরে বেছে নিয়েছিলেন কেন তাও উল্লেখ পাওয়া যায় মানসী তে।

সারমর্ম

এই কবিতায় কবি তার প্রেম আবেগকে এক অনন্য রূপ দিয়েছেন।তখন তিনি বলতে চেয়েছেন প্রকৃতির অন্যান্য রূপের কথা যুগ যুগ ধরে তার রূপ যেন প্রেমে মুগ্ধ করেছে।প্রতিবার কতইনা উপহার নিয়ে এসেছে বিভিন্ন রূপে বিভিন্ন মায়াতে। অন্যদিকে প্রাচীন কালে ঘটে যাওয়া দুঃখের ইতিহাস ও সমান গুরুত্বপূর্ণ কবির কাছে। হয়তো সেই  ইতিহাস নতুন কোনো প্রেক্ষাপট তৈরি করে তার ব্যথার দুঃখের কাহিনীগুলি উজার করে দেবে।উত্তর আকাশে জ্বলতে থাকা ধরুবতারা তার এ বার্তা বহন করে চলেছে।কিন্তু এরই মাঝে কবি প্রেমকে এক অনন্ত রূপ দিয়েছেন যার কোন শেষ নেই। ইতিহাস বদলায় সময় বদলায় কিন্তু প্রেম কখনো শেষ হয় না অনন্তকাল ধরে তা স্থায়ী হয়তো তা প্রকাশ পায় বিভিন্ন রূপে।এই প্রেমের টানে কত মানুষ কবি হতে চেয়েছেন।প্রেমের মধুর বাণী খোদাই করেছেন তার হৃদয়ের খাতায়।




মঙ্গলবার, ১২ মে, ২০২০

মে ১২, ২০২০

নাসিক হইতে খুড়ার পত্র(রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কবিতা)

নাসিক হইতে খুড়ার পত্র

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর 



কলকত্তামে চলা গয়ো রে সুরেনবাবু মেরা,
সুরেনবাবু, আসল বাবু, সকল বাবুকো সেরা।
খুড়া সাবকো কায়কো নহি পতিয়া ভেজো বাচ্ছা--
মহিনা-ভর্‌ কুছ খবর মিলে না ইয়ে তো নহি আচ্ছা!
টপাল্‌, টপাল্‌, কঁহা টপাল্‌রে, কপাল হমারা মন্দ,
সকাল বেলাতে নাহি মিলতা টপাল্‌কো নাম গন্ধ!
ঘরকো যাকে কায়কো বাবা, তুম্‌সে হম্‌সে ফর্‌খৎ।
দো-চার কলম লীখ্‌ দেওঙ্গে ইস্‌মে ক্যা হয় হর্‌কৎ!
প্রবাসকো এক সীমা পর হম্‌ বৈঠ্‌কে আছি একলা--
সুরিবাবাকো বাস্তে আঁখ্‌সে বহুৎ পানি নেক্‌লা।
সর্বদা মন কেমন কর্‌তা, কেঁদে উঠ্‌তা হির্দয়--
ভাত খাতা, ইস্কুল যাতা, সুরেনবাবু নির্দয়!
মন্‌কা দুঃখে হূহু কর্‌কে নিক্‌লে হিন্দুস্থানী--
অসম্পূর্ণ ঠেক্‌তা কানে বাঙ্গলাকো জবানী।
মেরা উপর জুলুম কর্‌তা তেরি বহিন বাই,
কী করেঙ্গা কোথায় যাঙ্গা ভেবে নাহি পাই!
বহুৎ জোরসে গাল টিপ্‌তা দোনো আঙ্গ্‌লি দেকে,
বিলাতী এক পৈনি বাজ্‌না বাজাতা থেকে থেকে,
কভী কভী নিকট আকে ঠোঁটমে চিম্‌টি কাটতা,
কাঁচিলে কর কোঁক্‌ড়া কোঁক্‌ড়া চুলগুলো সব ছাঁটতা,
জজসাহেব কুছ বোল্‌তা নহি রক্ষা করবে কেটা,
কঁহা গয়োরে কঁহা গয়োরে জজসাহেবকি বেটা!
গাড়ি চড়্‌কে লাঠিন পড়কে তুম্‌ তো যাতা ইস্কিল্‌
ঠোঁটে নাকে চিম্‌টি খাকে হমারা বহুৎ মুস্কিল!
এদিকে আবার party হোতা খেল্‌নেকোবি যাতা,
জিম্‌খানামে হিম্‌ঝিম্‌ এবং থোড়া বিস্কুট খাতা।
তুম ছাড়া কোই সম্‌জে না তো হম্‌রা দুরাবস্থা,
বহির তেরি বহুৎ merry খিল্‌খিল্‌ কর্কে হাস্তা!
চিঠি লিখিও মাকে দিও বহুৎ বহুৎ সেলাম,
আজকের মতো তবে বাবা বিদায় হোকে গেলাম।


সুরেনবাবু = সুরেন্দ্রনাথ ঠাকুর ।
টপাল্ = চিঠির ডাক ।
বহিন বাই = ইন্দিরা দেবী ।
জজসাহেব = অগ্রজ সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর , সুরেন্দ্রনাথের পিতা ।



মে ১২, ২০২০

আমরা চাষ করি আনন্দে -রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

আমরা চাষ করি আনন্দে

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর 



আমরা চাষ করি আনন্দে।
মাঠে মাঠে বেলা কাটে সকাল হতে সন্ধে॥
রৌদ্র ওঠে, বৃষ্টি পড়ে, বাঁশের বনে পাতা নড়ে,
বাতাস ওঠে ভরে ভরে চষা মাটির গন্ধে॥
সবুজ প্রাণের গানের লেখা রেখায় রেখায় দেয় রে দেখা,
মাতে রে কোন্‌ তরুণ কবি নৃত্যদোদুল ছন্দে।
ধানের শিষে পুলক ছোটে-- সকল ধরা হেসে ওঠে
অঘ্রানেরই সোনার রোদে, পূর্ণিমারই চন্দ্রে॥








মে ১২, ২০২০

পৃথিবী - রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর


পৃথিবী

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর



আজ আমার প্রণতি গ্রহন করো, পৃথিবী,
শেষ নমস্কারে অবনত দিনাবসানের বেদিতলে।।
মহাবীর্যবতী তুমি বীরভোগ্যা,
বিপরীত তুমি ললিতে কঠোরে,
মিশ্রিত তোমার প্রকৃতি পুরুষে নারীতে,
মানুষের জীবন দোলায়িত কর তুমি দু:সহ দ্বন্দ্বে।
ডান হাতে পূর্ণ কর সুধা,
বাম হাতে চুর্ণ কর পাত্র,
তোমার লীলাক্ষেত্র মুখরিত কর অট্টবিদ্রূপে;
দু:সাধ্য কর বীরের জীবনকে মহত্ জীবনে যার অধিকার।
শ্রেয়কে কর দুরমূল্য, কৃপা কর না কৃপাপাত্রকে।
তোমার গাছে গাছে প্রচ্ছন্ন রেখেছো প্রতি মুহূর্তের সংগ্রাম,
ফলে শস্যে তার জয়মাল্য হয় সার্থক।
জলে স্থলে তোমার ক্ষমাহীন রণরঙ্গভূমি-
সেখানে মৃত্যুর মুখে ঘোষিত হয় বিজয়ী প্রাণের জয়বার্তা।
তোমার নির্দয়তার ভিত্তিতে উঠেছে সভ্যতার জয়তোরণ
ত্রুটি ঘটলে তার পূর্ণ মূল্য শোধ হয় বিনাশে।।
তোমার ইতিহাসের আদিপর্বে দানবের ছিল দুর্জয়-
সে পুরুষ, সে বর্বর, সে মূঢ়।
তার অঙ্গুলি ছিল স্থুল, কলাকৌশলবর্জিত;
গদা-হাতে মুষল-হাতে লন্ডভন্ড করেছে সে সমুদ্র পর্বত;
অগ্নিতে বাষ্পেতে দু:স্বপ্ন ঘুলিয়ে তুলেছে আকাশে।
জড়রাজত্বে সে ছিল একাধিপতি,
প্রাণের ‘পরে ছিল তার অন্ধ ঈর্ষা।।
দেবতা এলেন পরযুগে, মন্ত্র পড়লেন দানবদমনের-
জড়ের ঔদ্ধত্য হল অভিভূত;
জীবধাত্রী বসলেন শ্যামল আস্তরণ পেতে।
উষা দাঁড়ালেন পূর্বাচলের শিখরচূড়ায়,
পশ্চিমসাগরতীরে সন্ধ্যা নামলেন মাথায় নিয়ে শান্তিঘট।।
নম্র হল শিকলে-বাঁধা দানব,
তবু সেই আদিম বর্বর আঁকড়ে রইল তোমার ইতিহাস।
ব্যবস্থার মধ্যে সে হঠাৎ আনে বিশৃঙ্খলতা-
তোমার স্বভাবের কালো গর্ত থেকে
হঠাৎ বেরিয়ে আসে এঁকেবেঁকে!
তোমার নাড়ীতে লেগে আছে তার পাগলামি।
দেবতার মন্ত্র উঠেছে আকাশে বাতাসে অরণ্যে
দিনে রাত্রে উদাত্ত অনুদাত্ত মন্দ্রস্বরে।
তবু তোমার বক্ষের পাতাল থেকে আধপোষা নাগদানব
ক্ষণে ক্ষণে উঠেছে ফণা তুলে-
তার তাড়নায় তোমার আপন জীবকে করেছ আঘাত,
ছারখার করছ আপন সৃষ্টিকে।।
শুভে-অশুভে স্থাপিত তোমার পাদপীঠে
তোমার প্রচন্ড সুন্দর মহিমার উদ্দেশে
আজ রেখে যাব আমার ক্ষতচিহ্নলাঞ্জিত জীবনের প্রণতি।
বিরাট প্রাণের, বিরাট মৃত্যুর, গুপ্তসঞ্চার তোমার যে মাটির তলায়
তাকে আজ স্পর্শ করি- উপলব্ধি করি সর্বদেহে মনে।
অগণিত যুগযুগান্তের অসংখ্য মানুষের লুপ্তদেহ পুঞ্জিত তার ধুলায়।
আমিও রেখে যাব কয়-মুষ্টি ধূলি, আমার সমস্ত সুখদু:খের শেষ পরিণাম-
রেখে যাব এই নামগ্রাসী আকারগ্রাসী সকল-পরিচয়-গ্রাসী
নি:শব্দ ধূলিরাশির মধ্যে।।
অচল অবরোধে আবদ্ধ পৃথিবী, মেঘলোকে উধাও পৃথিবী,
গিরিশৃঙ্গমালার মহৎ মৌনে ধ্যাননিমগ্না পৃথিবী,
নীলাম্বুরাশির অতন্দ্র তরঙ্গে কলমন্দ্রমুখরা পৃথিবী,
অন্নপূর্ণা তুমি সুন্দরী, অন্নরিক্তাতুমি ভীষণা।
একদিকে আপক্বধান্যভারনম্র তোমার শস্যত্রে-
সেখানে প্রসন্ন প্রভাতসূর্য প্রতিদিন মুছে নেয় শিশিরবিন্দু
কিরণ-উত্তরীয় বুলিয়ে দিয়ে;
অস্তগামী সূর্য শ্যামশস্যহিল্লোলে রেখে যায় অকথিত এই বাণী
”আমি আনন্দিত”।
অন্যদিকে তোমার জলহীন ফলহীন আতঙ্কপান্ডুর মরুক্ষেত্র
পরিকীর্ণ পশুকঙ্কালের মধ্যে মরীচিকার প্রেতনৃত্য।
বৈশাখে দেখেছি বিদ্যুত্চঞ্চুবিদ্ধ দিগন্তকে ছিনিয়ে নিতে এল
কালো শ্যেনপাখির মতো তোমার ঝড়-
সমস্ত আকাশটা ডেকে উঠল যেন কেশর-ফোলা সিংহ;
তার লেজের ঝাপটে ডালপালা আলুথালু করে
হতাশ বনস্পতি ধুলায় পড়ল উবুড় হয়ে;
হাওয়ার মুখে ছুটল ভাঙা কুঁড়ের চাল
শিকল-ছেঁড়া কয়েদি-ডাকাতের মতো।
আবার ফাল্গুনে দেখেছি তোমার আতপ্ত দক্ষিণে হাওয়া
ছড়িয়ে দিয়েছে বিরহমিলনের স্বগতপ্রলাপ আম্রমুকুলের গন্ধে;
চাঁদের পেয়ালা ছাপিয়ে দিয়ে উপচিয়ে পড়েছে স্বর্গীয় মদের ফেনা;
বনের মর্মরধ্বনি বাতাসের স্পর্ধায় ধৈর্য হারিয়েছে
অকস্মাৎ কল্লোলোচ্ছ্বাসে।।
স্নিগ্ধ তুমি, হিংস্র তুমি, পুরাতনী তুমি নিত্যনবীনা,
অনাদি সৃষ্টির যজ্ঞহুতাগ্নি থেকে বেরিয়ে এসেছিলে
সংখ্যাগণনার-অতীত প্রত্যুষে;
তোমার চক্রতীর্থের পথে পথে ছড়িয়ে এসেছে
শত শত ভাঙা ইতিহাসের অর্থলুপ্ত অবশেষ;
বিনা বেদনায় বিছিয়ে এসেছে তোমার বর্জিত সৃষ্টি
অগণ্য বিস্মৃতির স্তরে স্তরে।।
জীবপালিনী, আমাদের পুষেছ
তোমার খন্ডকালের ছোট ছোট পিঞ্জরে,
তারই মধ্যে সব খেলার সীমা, সব কীর্তির অবসান।।
আজ আমি কোন মোহ নিয়ে আসি নি তোমার সম্মুখে;
এতদিন যে দিনরাত্রির মালা গেঁথেছি বসে বসে
তার জন্য অমরতার দাবি করব না তোমার দ্বারে।
তোমার অযুত নিযুত বৎসর সূর্যপ্রদক্ষিণের পথে
যে বিপুল নিমেষগুলি উম্মীলিত নিমীলিতহতে থাকে
তারই এক ক্ষুদ্র অংশে কোন-একটি আসনের
সত্যমুল্য যদি দিয়ে থাকি,
জীবনের কোন-একটি ফলবান্ খন্ডকে
যদি জয় করে থাকি পরম দু:খে
তবে দিয়ো তোমার মাটির ফোঁটার একটি তিলক আমার কপালে;
সে চিহ্ন যাবে মিলিয়ে
যে রাত্রে সকল চিহ্ন পরম অচিনের মধ্যে যায় মিশে।।
হে উদাসীন পৃথিবী,
আমাকে সম্পূর্ণ ভোলবার আগে
তোমার নির্মম পদপ্রান্তে
আজ রেখে যাই আমার প্রণতি।।



মে ১২, ২০২০

বিদায় শেষের কবিতা থেকে -রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

বিদায় শেষের কবিতা থেকে

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর 




কালের যাত্রার ধ্বনি শুনিতে কি পাও।
তারি রথ নিত্যই উধাও
জাগাইছে অন্তরীক্ষে হৃদয়স্পন্দন,
চক্রে-পিষ্ট আঁধারের বক্ষফাটা তারার ক্রন্দন।
ওগো বন্ধু,
সেই ধাবমান কাল
জড়ায়ে ধরিল মোরে ফেরি তার জাল
তুলে নিল দ্রুতরথে
দুঃসাহসী ভ্রমণের পথে
তোমা হতে বহু দূরে।
মনে হয়, অজস্র মৃত্যুরে
পার হয়ে আসিলাম
আজি নবপ্রভাতের শিখরচূড়ায়--
রথের চঞ্চল বেগ হাওয়ায় উড়ায়
আমার পুরানো নাম।
ফিরিবার পথ নাহি;
দূর হতে যদি দেখ চাহি
পারিবে না চিনিতে আমায়।
হে বন্ধু, বিদায়।


কোনোদিন কর্মহীন পূর্ণ অবকাশে বসন্তবাতাসে
অতীতের তীর হতে যে রাত্রে বহিবে দীর্ঘশ্বাস,
ঝরা বকুলের কান্না ব্যথিবে আকাশ,
সেই ক্ষণে খুঁজে দেখো--কিছু মোর পিছে রহিল সে
তোমার প্রাণের প্রান্তে; বিস্মৃতিপ্রদোষে হয়তো দিবে সে জ্যোতি,
হয়তো ধরিবে কভু নাম-হারা স্বপ্নের মুরতি।
তবু সে তো স্বপ্ন নয়,
সব-চেয়ে সত্য মোর, সেই মৃত্যুঞ্জয়,
সে আমার প্রেম।


তারে আমি রাখিয়া এলেম
অপরিবর্তন অর্ঘ্য তোমার উদ্দেশে।
পরিবর্তনের স্রোতে আমি যাই ভেসে
কালের যাত্রায়। হে বন্ধু, বিদায়।



তোমার হয় নি কোনো ক্ষতি
মর্তের মৃত্তিকা মোর, তাই দিয়ে অমৃতমুরতি
যদি সৃষ্টি করে থাক, তাহারি আরতি
হোক তব সন্ধ্যাবেলা,
পূজার সে খেলা
ব্যাঘাত পাবে না মোর প্রত্যহের ম্লান স্পর্শ লেগে;
তৃষার্ত আবেগ-বেগে
ভ্রষ্ট নাহি হবে তার কোনো ফুল নৈবেদ্যের থালে।
তোমার মানস-ভোজে সযত্নে সাজালে
যে ভাবরসের পাত্র বাণীর তৃষায়,
তার সাথে দিব না মিশায়ে
যা মোর ধূলির ধন, যা মোর চক্ষের জলে ভিজে।


আজো তুমি নিজে হয়তো-বা করিবে রচন
মোর স্মৃতিটুকু দিয়ে স্বপ্নাবিষ্ট তোমার বচন।
ভার তার না রহিবে, না রহিবে দায়।
হে বন্ধু, বিদায়।


মোর লাগি করিয়ো না শোক,
আমার রয়েছে কর্ম, আমার রয়েছে বিশ্বলোক।
মোর পাত্র রিক্ত হয় নাই--
শূন্যেরে করিব পূর্ণ, এই ব্রত বহিব সদাই।
উৎকণ্ঠ আমার লাগি কেহ যদি প্রতীক্ষিয়া থাকে
সেই ধন্য করিবে আমাকে।
শুক্লপক্ষ হতে আনি
রজনীগন্ধার বৃন্তখানি
যে পারে সাজাতে
অর্ঘ্যথালা কৃষ্ণপক্ষ রাতে,
যে আমারে দেখিবারে পায়
অসীম ক্ষমায়
ভালো মন্দ মিলায়ে সকলি,
এবার পূজায় তারি আপনারে দিতে চাই বলি।


তোমারে যা দিয়েছিনু তার
পেয়েছ নিঃশেষ অধিকার।
হেথা মোর তিলে তিলে দান,
করুণ মুহূর্তগুলি গণ্ডূষ ভরিয়া করে পান
হৃদয়-অঞ্জলি হতে মম।
ওগো তুমি নিরুপম,
হে ঐশ্বর্যবান,
তোমারে যা দিয়েছিনু সে তোমারি দান--
গ্রহণ করেছ যত ঋণী তত করেছ আমায়।
হে বন্ধু, বিদায়।



মে ১২, ২০২০

শেষ চিঠি -রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

শেষ চিঠি

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর



মনে হচ্ছে শূন্য বাড়িটা অপ্রসন্ন,
অপরাধ হয়েছে আমার
তাই আছে মুখ ফিরিয়ে।
ঘরে ঘরে বেড়াই ঘুরে,
আমার জায়গা নেই--
হাঁপিয়ে বেরিয়ে চলে আসি।
এ বাড়ি ভাড়া দিয়ে চলে যাব দেরাদুনে।
অমলির ঘরে ঢুকতে পারি নি বহুদিন
মোচড় যেন দিত বুকে।
ভাড়াটে আসবে, ঘর দিতেই হবে সাফ ক'রে,
তাই খুললেম ঘরের তালা।
একজোড়া আগ্রার জুতো,
চুল বাঁধবার চিরুনি, তেল, এসেন্সের শিশি
শেলফে তার পড়বার বই,
ছোটো হার্মোনিয়ম।
একটা অ্যালবাম,
ছবি কেটে কেটে জুড়েছে তার পাতায়।
আলনায় তোয়ালে, জামা, খদ্দরের শাড়ি।
ছোটো কাঁচের আলমারিতে নানা রকমের পুতুল,
শিশি, খালি পাউডারের কৌটো।
চুপ করে বসে রইলেম চৌকিতে।
টেবিলের সামনে।
লাল চামড়ার বাক্স,
ইস্কুলে নিয়ে যেত সঙ্গে।
তার থেকে খাতাটি নিলেম তুলে,
আঁক কষবার খাতা।
ভিতর থেকে পড়ল একটি আখোলা চিঠি,
আমারি ঠিকানা লেখা
অমলির কাঁচা হাতের অক্ষরে।
শুনেছি ডুবে মরবার সময়
অতীত কালের সব ছবি
এক মুহূর্তে দেখা দেয় নিবিড় হয়ে--
চিঠিখানি হাতে নিয়ে তেমনি পড়ল মনে
অনেক কথা এক নিমেষে।
অমলার মা যখন গেলেন মারা
তখন ওর বয়স ছিল সাত বছর।
কেমন একটা ভয় লাগল মনে,
ও বুঝি বাঁচবে না বেশি দিন।
কেননা বড়ো করুণ ছিল ওর মুখ,
যেন অকালবিচ্ছেদের ছায়া
ভাবীকাল থেকে উল্টে এসে পড়েছিল
ওর বড়ো বড়ো কালো চোখের উপরে।
সাহস হ'ত না ওকে সঙ্গছাড়া করি।
কাজ করছি আপিসে বসে,
হঠাৎ হ'ত মনে
যদি কোনো আপদ ঘটে থাকে।
বাঁকিপুর থেকে মাসি এল ছুটিতে--
বললে, "মেয়েটার পড়াশুনো হল মাটি।
মুর্খু মেয়ের বোঝা বইবে কে
আজকালকার দিনে।'
লজ্জা পেলেম কথা শুনে তার,
বললেম "কালই দেব ভর্তি করে বেথুনে'।
ইস্কুলে তো গেল,
কিন্তু ছুটির দিন বেড়ে যায় পড়ার দিনের চেয়ে।
কতদিন স্কুলের বাস্‌ অমনি যেত ফিরে।
সে চক্রান্তে বাপেরও ছিল যোগ।
ফিরে বছর মাসি এল ছুটিতে;
বললে, "এমন করে চলবে না।
নিজে ওকে যাব নিয়ে,
বোর্ডিঙে দেব বেনারসের স্কুলে,
ওকে বাঁচানো চাই বাপের স্নেহ থেকে।'
মাসির সঙ্গে গেল চলে।
অশ্রুহীন অভিমান
নিয়ে গেল বুক ভরে
যেতে দিলেম বলে।
বেরিয়ে পড়লেম বদ্রিনাথের তীর্থযাত্রায়
নিজের কাছ থেকে পালাবার ঝোঁকে।
চার মাস খবর নেই।
মনে হল গ্রন্থি হয়েছে আলগা
গুরুর কৃপায়।
মেয়েকে মনে মনে সঁপে দিলেম দেবতার হাতে,
বুকের থেকে নেমে গেল বোঝা।
চার মাস পরে এলেম ফিরে।
ছুটেছিলেম অমলিকে দেখতে কাশীতে--
পথের মধ্যে পেলেম চিঠি--
কী আর বলব,
দেবতাই তাকে নিয়েছে।
যাক সে-সব কথা।
অমলার ঘরে বসে সেই আখোলা চিঠি খুলে দেখি,
তাতে লেখা--
"তোমাকে দেখতে বড্‌ডো ইচ্ছে করছে'।
আর কিছুই নেই।




মে ১২, ২০২০

জীবন - জীবনানন্দ দাশ

জীবন

জীবনানন্দ দাশ



চারিদিকে বেজে ওঠে অন্ধকার সমুদ্রের স্বর-
নতুন রাত্রির সাথে পৃথিবীর বিবাহের গান!
ফসল উঠিছে ফলে-রসে রসে ভরিছে শিকড়;
লক্ষ নক্ষত্রের সাথে কথা কয় পৃথিবীর প্রাণ।
সে কোন প্রথম ভোরে পৃথিবীতে ছিল যে সন্তান
অঙ্কুরের মতো আজ জেগেছে সে জীবনের বেগে!
আমার দেহের গন্ধ পাই তার শরীরের ঘ্রাণ-
সিন্ধুর ফেনার গন্ধ আমার শরীরে আছে লেগে!
পৃথিবী রয়েছে জেগে চক্ষু মেলে-তার সাথে সে ও আছে জেগে!


নক্ষত্রের আলো জ্বেলে পরিষ্কার আকাশের ’পর
কখন এসেছে রাত্রি! – পশ্চিমের সাগরের জলে
তার শব্দ;- উত্তর সমুদ্র তার, – দক্ষিন সাগর
তাহার পায়ের শব্দে- তাহার পায়ের কোলাহলে
ভ’রে ওঠে; – এসেছে রাত্রি! – এসেছে সে আকাশের নক্ষত্রের তলে
প্রথম যে এসেছিল, তারই মতো; – তাহার মতন
চোখ তার, – তাহার মতন চুল, – বুকের আঁচলে
প্রথম মেয়ের মতো;- পৃথিবীর নদী মঠ বন
আবার পেয়েছে তারে, – সমুদ্রের পারে রাত্রি এসেছে এখন!


সে এসেছে,- আকাশের শেষ আলো পশ্চিমের মেঘে
সন্ধ্যার গহ্বর খুঁজে পালায়েছে! – রক্তে রক্তে লাল
হয়ে গেছে বুক তার, – আহত চিতার মতো বেগে
পালায়ে গিয়েছে রোদ,- স’রে গেছে আলোর বৈকাল!
চলে গেছে জীবনের ‘আজ’ এক, – আর এক ‘কাল;
আসিত না যদি আর আলো লয়ে- রৌদ্র সঙ্গে লয়ে!-
এই রাত্রি- নক্ষত্র সমুদ্র লয়ে এমন বিশাল
আকাশের বুক থেকে পড়িত না যদি আর ক্ষ’য়ে
রয়ে যেত,- যে গান শুনি নি আর তাহার স্মৃতির মতো হয়ে!


যে পাতা সবুজ ছিল,- তবুও হলুদ হতে হয়,-
শীতের হাড়ের হাত আজও তারে যায় নাই ছুঁয়ে-
যে মুখ যুবার ছিল, তবু যার হয়ে যায় ক্ষয়,
হেমন্ত রাতের আগে ঝ’রে যায়,- প’ড়ে যায় নুয়ে;-
পৃথিবীর এই ব্যথা বিহ্বলতা অন্ধকারে ধুয়ে
পূর্ব সাগরের ঢেউয়ে,- জলে জলে, পশ্চিম সাগরে
তোমার বিনুনি খুলে,- হেঁট হয়ে, – পা তোমার থুয়ে,-
তোমার নক্ষত্র জ্বেলে- তোমার জলের স্বরে স্বরে
রয়ে যেতে যদি আকাশের নিচে-নীল পৃথিবীর ’পরে!


ভোরের সূয়ের আলো পৃথিবীর গুহায় যেমন
মেঘের মতন চুল- অন্ধকার চোখের আস্বাদ
একবার পেতে চায়;- যে জন রয় না- যেই জন
চলে যায়, তারে পেতে আমাদের বুকে যেই সাধ-
যে ভালোবেসেছে শুধু, হয়ে গেছে হৃদয় অবাধ
বাতাসের মতো যার,- তাহার বুকের গান শুনে
মনে যেই ইচ্ছা জাগে;- কোন দিন দেখে নাই চাঁদ
যেই রাত্রি,- নেমে আসে লক্ষ লক্ষ নক্ষত্রেরে শুনে
যেই রাত্রি, আমি তার চোখে চোখ, চুলে তার চুল নেব বুনে!


তুমি রয়ে যাবে,- তবু,- অপেক্ষায় রয় না সময়
কোনোদিন;- কোনোদিন রবে না সে পথ থেকে স’রে!
সকলেই পথ চলে,- সকলেই ক্লান্ত তবু হয়;-
তবুও দু’জন কই ব’সে থাকে হাতে হাত ধ’রে!
তবুও দু’জন কই কে কাহারে রাখে কোলে করে!
মুখে রক্ত ওঠে- তবু কমে কই বুকের সাহাস!
যেতে হবে,- কে এসে চুলে ঝুঁটি টেনে লয় জোরে!
শরীরের আগে কবে ঝরে যায় হৃদয়ের রস!-
তবু,-চলে,-মৃত্যুর ঠোঁটের মতো দেহ যার হয় নি অবশ!


হলদে পাতার মতো আমাদের পথে ওড়াউড়ি!-
কবরের থেকে শুধু আকাঙ্খার ভূত লয়ে খেলা!-
আমরাও ছায় হয়ে ভূত হয়ে করি ঘোরাঘুরি!
-মনের নদীর পার নেমে আসে তাই সন্ধ্যাবেলা
সন্ধ্যার অনেক আগে! – দুপুরেই হয়েছি একেলা!
আমরাও চরি-ফিরি কবরের ভূতের মতন!
বিকাল বেলার আগে ভেঙ্গে গেছে বিকালের মেলা-
শরীর রয়েছে, তবু মরে গেছে আমাদের মন!
হেমন্ত আসে নি মাঠে,- হলুদ পাতায় ভরে হৃদয়ের বন!


শীত রাত ঢের দূরে,- অস্থি তবু কেঁপে ওঠে শীতে!
শাদা হাতদুটো শাদা হাড় হয়ে মৃত্যুর খবর
একবার মনে আনে,- চোখ বুজে তবু কি ভুলিতে
পারি এই দিনগুলো!- আমাদের রক্তের ভিতর
বরফের মতো শীত, আগুনের মতো তবু জ্বর!
যেই গতি,- সেই শক্তি পৃথিবীর অন্তরে পঞ্জরে;-
সবুজ ফলায়ে যায় পৃথিবীর বুকের উপর,-
তেমনি স্ফুলিঙ্গ এক আমাদের বুকে কাজ করে!
শস্যের কীটের আগে আমাদের হৃদয়ের শস্য তবু মরে!


যতদিন রয়ে যাই এই শক্তি রয়ে যায় সাথে-
বিকালের দিকে যেই ঝড় আসে তাহার মতন!
যে ফসল নষ্ট হবে তারই ক্ষেত উড়াতে ফুরাতে
আমাদের বুকে এসে এই শক্তি করে আয়োজন!
নতুন বীজের গন্ধে ভ’রে দেয় আমাদের মন
এই শক্তি,- একদিন হয়েতো বা ফলিবে ফসল!-
এরই জোরে একদিন হয়তো বা ফলিবে ফসল!-
এরই জোরে একদিন হয়তো বা হৃদয়ের বন
আহ্লাদে ফেলিবে ভ’রে অলক্ষিত আকাশের তল!
দুরন্ত চিতার মতো গতি তার, – বিদ্যুতের মতো সে চঞ্চল!


১০
অঙ্গারের মতো তেজ কাজ করে অন্তরের তলে,-
যখন আকাঙ্খা এক বাতাসের মতো বয়ে আসে,
এই শক্তি আগুনের মতো তার জিভ তুলে জ্বলে!
ভস্মের মতন তাই হয়ে যায় হৃদয় ফ্যাকাশে!
জীবন ধোঁয়ার মতো,- জীবন ছায়র মতো ভাসে;
যে অঙ্গার জ্ব’লে জ্বলে নিভে যাবে,- হয়ে যাবে ছাই,-
সাপের মত বিষ লয়ে সেই আগুনের ফাঁসে
জীবন পুড়িয়া যায়;- আমরাও ঝরে পুড়ে যাই!
আকাশে নক্ষত্র হয়ে জ্বলিবার মতো শক্তি-তবু শক্তি চাই!


১১
জানো তুমি?- শিখেছ কি আমাদের ব্যর্থতার কথা?-
হে ক্ষমতা, বুকে তুমি কাজ কর তোমার মতনং-
তুমি আছ,- রবে তুমি,- এর বেশী কোনো নিশ্চয়তা
তুমি এসে দিয়েছ কি?- ওগো মন, মানুষের মন-
হে ক্ষমতা,- বিদ্যুতের মতো তুমি সুন্দর-ভীষণ!
মেঘের ঘোড়ার ’পরে আকাশের শিকারীর মতো;-
সিন্ধুর সাপের মতো লক্ষ ঢেউয়ে তোল আলোড়ন!
চমৎকৃত কর,- শরীরেরে তুমি করেছ আহত!-
যতই জেগেছ,- দেহ আমাদের ছিঁড়ে যেতে চেয়েছে যে তত!


১২
তবু তুমি শীত রাতে আড়ষ্ট সাপের মতো শুয়ে
হৃদয়ের অন্ধকারে পড়ে থাক,- কুন্ডলী পাকায়ে!-
অপেক্ষায় ব’সে থাকি,-স্ফুলিঙ্গের মতো যাবে ছুঁয়ে
কে তোমারে!- ব্যাধের পায়ের পাড়া দিয়ে যাবে গায়ে
কে তোমার!- কোন অশ্র“, কোন পীড়া হতাশার ঘায়ে
কখন জাগিয়া ওঠো- স্থির হয়ে বসে আছি তাই।
শীত-রাত বাড়ে আরো,- নক্ষত্রেরা যেতেছে হারায়ে,-
ছাইয়ে যে আগুন ছিল সেই সবও হয়ে যায় ছাই!
তবুও আরেকবার সব ভস্মে অন্তরের আগুন ধরাই।


১৩
অশান্ত হাওয়ার বুকে তবু আমি বনের মতন
জীবনেরে ছেড়ে দিছি!- পাতা আর পল্লবের মতো
জীবন উঠেছে বেজে শব্দে-স্বরে; যতবার মন
ছিঁড়ে গেছে,-হয়েছে দেহের মতো হৃদয় আহত
যতবার;- উড়ে গেছে শাখা, পাতা পড়ে গেছে যত;-
পৃথিবীর বন হয়ে-ঝড়ের গতির মতো হয়ে,
বিদ্যুতের মতো হয়ে আকাশের মেঘে ইতস্তত;
একবার মৃত্যু লয়ে- একবার জীবনেরে লয়ে
ঘূর্ণির মতন বয়ে যে বাতাস ছেঁড়ে,- তার মতো গেছি বয়ে!


১৪
কোথায় রয়েছে আলো আধারের বীণার আস্বাদ!
ছিন্ন রুগ্ন ঘুমন্তের চোখে এক সুস্থ স্বপ্ন হয়ে
জীবন দিয়েছে দেখা;-আকাশের মতন অবাধ
পরিচ্ছন্ন পৃথিবীতে, সিন্ধুর হাওয়ার মতো বয়ে
জীবন দিয়েছে দেখা;- জেগে উঠে সেই ইচ্ছা লয়ে
আড়ষ্ট তারার মতো চমকায়ে গেছি শীতে মেঘে!
ঘুমায়ে যা দেখি নাই, জেগে উঠে তার ব্যথা সয়ে
নির্জন হতেছে ঢেউ হৃদয়ের রক্তের আবেগে!
যে আলো নিভিয়া গেছে তাহার ধোঁয়ার মতো প্রাণ আছে জেগে।


১৫
নক্ষত্র জেনেছে কবে অই অর্থ শৃঙ্খলার ভাষা!
বীণার তারের মতো উঠিতেছে বাজিয়া আকাশে
তাদের গতির ছন্দ,- অবিরত শক্তির পিপাসা
তাহাদের,- তবু সব তৃপ্ত হয়ে পূর্ণ হয়ে আসে!
আমাদের কাল চলে ইশারায়,- আভাসে-আভাসে!
আরম্ভ হয় না কিছু-সমস্তের তবু শেষ হয়,-
কীট যে ব্যর্থতা জানে পৃথিবীর ধুলো মাটি ঘাসে
তারও বড় ব্যর্থতার সাথে রোজ হয় পরিচয়!
যা হয়েছে শেষ হয়,- শেষ হয় কোনোদিন যা হবার নয়!-


১৬
সমস্ত পৃথিবী ভ’রে হেমন্তের সন্ধ্যার বাতাস
দোলা দিয়ে গেল কবে!- বাসি পাতা ভূতের মতন
উড়ে আসে!-কাশের রোগীর মতো পৃথিবীর শ্বাস,-
যক্ষার রোগীর মতো ধুঁকে মরে মানুষের মন!-
জীবনের চেয়ে সুস্থ মানুষের নিভৃত মরণ!
মরণ,- সে ভালো এই অন্ধকার সমুদ্রের পাশে!
বাঁচিয়া থাকিতে যারা হিঁচড়ায়- করে প্রাণপণ,-
এই নক্ষত্রের তলে একবার তারা যদি আসে,-
রাত্রিরে দেখিয়া যায় একবার সমুদ্রের পারের আকাশে!-


১৭
মৃত্যুরেও তবে তারা হয়তো ফেলিবে বেসে ভালো!
সব সাধ জেনেছে যে সেও চায় এই নিশ্চয়তা!
সকল মাটির গন্ধ আর সব নক্ষত্রের আলো
যে পেয়েছে,- সকল মানুষ আর দেবতার কথা
যে জেনেছে,- আর এক ক্ষুধা তবু-এক বিহ্বলতা
তাহারও জানিতে হয়! এইমতো অন্ধকারে এসে!-
জেগে জেগে যা জেনেছ,- জেনেছ তা-জেগে জেনেছ তা,-
নতুন জানিবে কিছু হয়তো বা ঘুমের চোখে সে!
সব ভালোবাসা যার বোঝা হল,-দেখুক সে মৃত্যু ভালোবেসে!


১৮
কিংবা এই জীবনেরে একবার ভালোবেসে দেখি!-
পৃথিবীর পথে নয়,- এইখানে-এইখানে ব’সে-
মানুষ চেয়েছে কিবা? পেয়েছে কি?-কিছু পেয়েছে কি!
হয়তো পায় নি কিছু-যা পেয়েছে, তাও গেছে খ’সে
অবহেলা ক’রে ক’রে কিংবা তার নক্ষত্রের দোষে;-
ধ্যানের সময় আসে তারপর,-স্বপ্নের সময়!
শরীর ছিঁড়িয়া গেছে,-হৃদয় পড়িয়া গেছে ধসে!-
অন্ধকার কথা কয়,- আকাশের তারা কথা কয়
তারপর,-সব গতি থেমে যায়,- মুছে যায় শক্তির বিস্ময়!


১৯
কেউ আর ডাকিবে না,- এইখানে এই নিশ্চয়তা!-
তোমার দু-চোখ কেউ দেখে থাকে যদি এই পৃথিবীতে,
কেউ যদি শুনে থাকে কবে তুমি কী কয়েছ কথা,
তোমার সহিত কেউ থেকে থাকে যদি সেই শীতে,-
সেই পৃথিবীর শীতে,- আসিবে কি তোমারে চিনিতে
এইখানে সে আবার!- উঠানে পাতার ভিড়ে ব’সে,
কিংবা ঘরে- হয়তো দেয়ালে আলো জ্বেলে দিতে দিতে,-
যখন হঠাৎ নিভে যাবে তার হাতের আলো সে,-
অসুস্থ পাতার মতো দুলে তার মন থেকে প’ড়ে যাব খসে!


২০
কিংবা কেউ কোনোদিন দেখে নাই,- চেনে নি আমারে!
সকাল বেলার আলো ছিল যার সন্ধ্যার মতন,-
চকিত ভূতের মতো নদী আর পাহাড়ের ধারে
ইশারায় ভূত ডেকে জীবনের সব আয়োজন
আরম্ভ সে করেছিল!-কোনোদিন কোনো লোকজন
তার কাছে আসে নাই;- আকাঙ্খার কবরের ’পরে
পুবের হাওয়ার মতো এসেছে সে হঠাৎ কখন!-
বীজ বুনে গেছে চাষা,- সে বাতাস বীজ নষ্ট করে!
ঘুমের চোখের ’পরে নেমে আসে অশ্র“ আর অনিদ্রার স্বরে!


২১
যেমন বৃষ্টির পরে ছেঁড়া ছেঁড়া কালো মেঘ এসে
আবার আকাশ ঢাকে,- মাঠে মাঠে অধীর বাতাস
ফোঁপায় শিশুর মতো,- একবার চাঁদ ওঠে ভেসে,-
দূরে-কাছে দেখা যায় পৃথিবীর ধান ক্ষেত ঘাস,
আবার সন্ধ্যার রঙে ভরে ওঠে সকল আকাশ,-
মড়ার চোখের রঙে সকল পৃথিবী থাকে ভ’রে!-
যে মরে যেতেছে তার হৃদয়ের সব শেষ শ্বাস
সকল আকাশ আর পৃথিবীর থেকে পড়ে ঝ’রে!-
জীবনে চলেছি আমি সে পৃথিবী আকাশের পথ ধ’রে ধ’রে!


২২
রাত্রির ফুলের মতো-ঘুমন্তে হৃদয়ের মতো
অন্তর ঘুমিয়ে গেছে,-ঘুমায়েছে মৃত্যুর মতন!-
সারাদিন বুকে ক্ষুধা লয়ে চিতা হয়েছে আহত,-
তারপর,- অন্ধকার গুহা এই-ছায়াভরা বন
পেয়েছে যে!- অশান্ত হাওয়ার মতো মানুষের মন
বুজে গেছে-রাত্রি আর নক্ষত্রের মাঝখানে এসে!-
মুত্যুর শান্তির স্বাদ এইখানে দিতেছে জীবন,-
জীবনেরে এইখানে একবার দেখি ভালোবেসে!
শুনে দেখি,- কোন কথা কয় রাত্রি, কোন কথা নক্ষত্র বলে সে!


২৩
পৃথিবীর অন্ধকার অধীর বাতাসে গেছে ভরে-
শস্য ফলে গেছে মাঠে,- কেটে নিয়ে চলে গেছে চাষা;
নদীর পারের বন মানুষের মতো শব্দ করে
নির্জন ঢেউয়ের কানে মানুষের মনের পিপাসা,-
মুত্যুর মত তার জীবনের বেদনার ভাষা,-
আবার জানায়ে যায়!-কবরের ভূতের মতন
পৃথিবীর বুকে রোজ লেগে থাকে যে আশা-হতাশা,-
বাতাসে ভাসিতেছিল ঢেউ তুলে সেই আলোড়ন!
মড়ার কবর ছেড়ে পৃথিবীর দিকে তাই ছুটে গেল মন!


২৪
হলুদ পাতার মতো,- আলোয়ার বাষ্পের মতন,
ক্ষীণ বিদ্যুতের মতো ছেঁড়া-মেঘ আকাশের ধারে,
আলোর মাছির মতো-রুগ্নের স্বপ্নের মতো মন
একবার ছিল ঐ পৃথিবীর সমুদ্রে পাহাড়ে,-
ঢেউ ভেঙে ঝ’রে যায়, -মরে যায়,- কে ফেরাতে পারে!
মৃত্যুরেও তার সেই কবরের গহ্বরে আঁধারে
জীবন ডাকিতে আসে;-হয় নাই-গিয়েছে যা হয়ে,
মৃত্যুরেও ডাক তুমি সেই ব্যথা-আকাঙ্খার অস্থিরতা লয়ে!


২৫
মৃত্যুরে বন্ধুর মতো ডেকেছি তো,- প্রিয়ার মতনং
চকিত শিশুর মতো তার কোলে লুকায়েছি মুখ;
রোগীর জরের মতো পৃথিবীর পথের জীবন;
অসুস্থ চোখের ’পরে অনিদ্রার মতন অসুখ;
তাই আমি প্রিয়তম;-প্রিয়া বলে জড়ায়েছি বুক,-
ছায়ার মতন আমি হয়েছি তোমার পাশে গিয়া!-
যে-ধুপ নিভিয়া যায় তার ধোঁয়া আঁধারে মিশুক,-
যে ধোঁয়া মিলায়ে যায় তারে তুমি বুকে তুলে নিয়া
ঘুমানো গন্ধের মতো স্বপ্ন হয়ে তার ঠোঁটে চুমো দিয়ো, প্রিয়া!


২৬
মৃত্যুকে ডেকেঠি আমি প্রিয়ের অনেক নাম ধ’রে।
যে বালক কোনোদিন জানে নাই গহ্বরের ভয়,
পুবের হাওয়ার মতো ভূত হয়ে মন তার ঘোরে!-
নদীর ধারে সে ভূত একদিন দেখেছে নিশ্চয়!
পায়ের তলের পাতা-পাপড়ির মতো মনে হয়
জীবনেরে,- খ’সে ক্ষয়ে গিয়েছে যে, তাহার মতন
জীবন পড়িয়া থাকে- তার বিছানায় খেদ,-ক্ষয়-
পাহাড় নদীর পারে হাওয়া হয়ে ভূত হয়ে মন
চকিত পাতার শব্দে বাতাসের বুকে তারে করে অন্বেষণ।


২৭
জীবন,- আমার চোখে মুখ তুমি দেখেছ তোমার,-
একটি পাতার মতো অন্ধকারে পাতা-ঝরা গাছে;-
একটি বোঁটার মতো যে ফুল ঝরিয়া গেছে তার;-
একাকী তারার মতো, সব তারা আকাশের কাছে
যখন মুছিয়া গেছে,-পৃথিবীতে আলো আসিয়াছে;-
যে ভালোবেসেছে, তার হৃদয়ের ব্যথার মতন;-
কাল যাহা থাকিবে না,- আজই যাহা স্মৃতি হয়ে আছে;-
দিন-রাত্রি-আমাদের পৃথিবীর জীবন তেমন!
সন্ধ্যার মেঘের মতো মুহুর্তের রঙ লয়ে মুহূর্তে নূতন!


২৮
আশঙ্কা ইচ্ছার পিছে বিদ্যুতের মতো কেঁপে ওঠে!
বীণার তারের মতো কেঁপে কেঁপে ছিয়ে যায় প্রাণ!
অসংখ্যা পাতার মতো লুটে তারা পথে পথে ছোটে,-
অধীর ঢেউয়ের মতো-অশান্ত হাওয়ার মতো গান
কোনদিকে ভেসে যায়-উড়ে যায়,-কয় কোন কথা!-
ভোরের আলোয় আজ শিশিরের বুকে যেই ঘ্রাণ,
রহিবে না কাল তার কোনো স্বাদ-কোনো নিশ্চয়তা!
পান্ডুর পাতার রঙ গালে,-তবু রক্তে তার রবে অসুস্থতা!


২৯
যেখানে আসে নি চাষা কোনোদিন কাস্তে হাতে লয়ে,
জীবনের বীজ কেউ বোনে নাই যেইখানে এসে,
নিরাশার মতো ফেঁপে চোখ বুজে পলাতক হয়ে
প্রেমের মৃত্যুর চোখে সেইখানে দেখিয়াছি শেষে!
তোমার চোখের ’পরে তাহার মুখেরে ভালোবেসে
এখানে এসেছি আমি,- আর একবার কেঁপে উঠে
অনেক ইচ্ছার বেগে,- শান্তির মতন অবশেষে
সব ঢেউ ভেঙে নিয়ে ফেনার ফুলের মতো ফুটে,
ঘুমাব বালির ’পরে;- জীবনের দিকে আর যাব নাকো ছুটে!


৩০
নির্জন রাত্রির মতো শিশিরের গুহার ভিতরে,-
পৃথিবীর ভিতরের গহ্বরের মতন নিঃসাড়
রব আমি;- অনেক গতির পর-আকাঙ্খার পরে
যেমন থামিতে হয়, বুজে যেতে হয় একবার
পৃথিবীর পারে থেকে কবরের মৃত্যুর ওপার
যেমন নিস্তব্ধ শান্ত নিমীলিত শূন্য মনে হয়-
তেমন আস্বাদ এক কিংবা সেই স্বাদহীনতার
সাথে একবার হবে মুখোমুখি সব পরিচয়!
শীতের নদীর বুকের মৃত জোনাকির মুখ তবু সব নয়!


৩১
আবার পিপাসা সব ভূত হয়ে পৃথিবীর মাঠে,-
অথবা গ্রহের ’পরে-ছায়া হয়ে, ভূত হয়ে ভাসে!-
যেমন শীতের রাতে দেখা যায় জোছনা ধোঁয়াটে,
ফ্যাকাশে পাতার ’পরে দাঁড়ায়েছে উঠানের ঘাসে;-
যেমন হঠাৎ দুটো কালো পাখা চাঁদের আকাশে
অনেক গভীর রাতে চমকের মতো মনে হয়;
কার পাখা?- কোন পাখি? পাখি সে কি! অথচ সে আসে!-
তখন অনেক রাতে কবরের মুখ কথা কয়!-
ঘুমন্ত তখন ঘুমে, জাগিতে হতেছে যার সে জাগিয়া রয়!


৩২
বনের পাতার মতো,- আলেয়ার বাষ্পের মতন,
ক্ষীণ বিদ্যুতের মতো ছেঁড়া মেঘে আকাশের ধারে,
আলোর মাছির মতো-রুগ্নের স্বপ্নের মতো মন
একবার ছিল ঐ পৃথিবীর সমুদ্রে পাহাড়ে,-
ঢেউ ভেঙে ঝরে যায়-মরে যায়,- কে ফেরাতে পারে!
তবুও ইশারা ক’রে ফাল্গুনরাতের গন্ধে বয়ে
মৃত্যুরেও তার সেই কবরের গহ্বরে আাঁধারে
জীবন ডাকিতে আসে;- হয় নাই,- গিয়েছে যা হয়ে,-
মৃত্যুরেও ডাক তুমি সেই স্মৃতি-আকাঙ্খার অস্থিরতা লয়ে!


৩৪
পৃথিবীর অন্ধকার অধীর বাতাসে গেছে ভরে-
শস্য ফলে গেছে মাঠে,- কেটে নিয়ে চলে গেছে চাষা;
নদীর পারের বন মানুষের মতো শব্দ করে
নির্জন ঢেউয়ের কানে মানুষের মনের পিপাসা,-
মুত্যুর মত তার জীবনের বেদনার ভাষা,-
আবার জানায়ে যায়!-কবরের ভূতের মতন
পৃথিবীর বুকে রোজ লেগে থাকে যে আশা-হতাশা,-
বাতাসে ভাসিতেছিল ঢেউ তুলে সেই আলোড়ন!
মড়ার কবর ছেড়ে পৃথিবীর দিকে তাই ছুটে গেল মন!



মে ১২, ২০২০

কুড়ি বছর পরে(বিখ্যাত বাংলা কবিতা)

কুড়ি বছর পরে

জীবনানন্দ দাশ 




আবার বছর কুড়ি পরে তার সাথে দেখা যদি হয়
আবার বছর কুড়ি পরে-
হয়তো ধানের ছড়ার পাশে
কার্তিকের মাসে-
তখন সন্ধ্যার কাক ঘরে ফেরে- তখন হলুদ নদী
নরম নরম শর কাশ হোগলায়- মাঠের ভিতরে !


অথবা নাইকো ধান ক্ষেতে আর,
ব্যস্ততা নাই আর,
হাঁসের নীড়ের থেকে খড়
পাখির নীড় থেকে খড়
ছড়াতেছে; মনিয়ার ঘরে রাত, শীত আর শিশিরের জল !
জীবন গিয়েছে চলে আমাদের কুড়ি, কুড়ি, বছরের পার,-
তখন হঠাৎ যদি মেঠো পথে পাই আমি তোমারে আবার !
হয়তো এসেছে চাঁদ মাঝরাতে একরাশ পাতার পিছনে
সরু- সরু- কালো কালো ডালপালা মুখে নিয়ে তার,
শিরীষের অথবা জামের
ঝাউয়ের-আমেরঃ
কুড়ি বছরের পরে তখন তোমারে নাই মনে !


জীবন গিয়েছে চলে আমাদের কুড়ি-কুড়ি বছরের পার-
তখন আবার যদি দেখা হয় তোমার আমার !
তখন হয়তো মাঠে হামাগুড়ি দিয়ে পেচা নামে-
বাবলার গলির অন্ধকারে
অশথের জানালার ফাকে
কোথায় লুকায় আপনাকে !
চোখের পাতার মতো নেমে চুপি কোথায় চিলের ডানা থামে-
সোনালি সোনালি চিল- শিশির শিকার করে নিয়ে গেছে তারে-
কুড়ি বছর পরে সেই কুয়াশায় পাই যদি হঠাৎ তোমারে !



মে ১২, ২০২০

এই পৃথিবীতে এক স্থান আছে( বিখ্যাত বাংলা কবিতা)

এই পৃথিবীতে এক স্থান আছে

জীবনানন্দ দাশ 




এই পৃথিবীতে এক স্থান আছে – সবচেয়ে সুন্দর করুণ :
সেখানে সবুজ ডাঙা ভ’রে আছে মধুকূপী ঘাসে অবিরল;
সেখানে গাছের নাম : কাঁঠাল, অশ্বত্থ, বট, জারুল, হিজল;
সেখানে ভোরের মেঘে নাটার রঙের মতো জাগিছে অরুণ;
সেখানে বারুণী থাকে গঙ্গাপসাগরের বুকে, – সেখানে বরুণ
কর্ণফুলী ধলেশ্বরী পদ্মা জলাঙ্গীরে দেয় অবিরল জল;
সেইখানে শঙ্খচিল পানের বনের মতো হাওয়ায় চঞ্চল,
সেইখানে লক্ষ্ণীপেঁচা ধানের গন্ধের মতো অস্ফুট, তরুণ;


সেখানে লেবুর শাখা নুয়ে থাকে অন্ধকারে ঘাসের উপর;
সুদর্শন উড়ে যায় ঘরে তার অন্ধকার সন্ধ্যার বাতাসে;
সেখানে হলুদ শাড়ি লেগে থাকে রূপসীর শরীরের ’পর –
শঙ্খমালা নাম তার : এ- বিশাল পৃথিবীর কোনো নদী ঘাসে
তারে আর খুঁজে তুমি পাবে নাকো বিশালাক্ষী দিয়েছিল বর,
তাই সে জন্মেছে নীল বাংলার ঘাস আর ধানের ভিতর।



মে ১২, ২০২০

অনন্ত জীবন যদি পাই আমি(বিখ্যাত বাংলা কবিতা)


অনন্ত জীবন যদি পাই আমি

জীবনানন্দ দাশ





অনন্ত জীবন যদি পাই আমি তাহ’লে অনন্তকাল একা
পৃথিবীর পথে আমি ফিরি যদি দেখিবো সবুজ ঘাস ফুটে উঠে
দেখিবো হলুদ ঘাস ঝরে যায় দেখিবো আকাশ শাদা হয়ে উঠে ভোরে-
ছেঁড়া মুনিয়ার মত রাঙা রক্ত—রেখা লেগে থাকে বুকে
তার সন্ধ্যায়—বারবার নক্ষত্রের দেখা পাবো আমি;
দেখিবো অচেনা নারী আলগা খোঁপার ফাঁস খুলে ফেলে চলে যায়
মুখে তার নাই আহা গোধূলির নরম আভাস।


অনন্ত জীবন যদি পাই আমি—তাহ’লে অসীমকাল একা
পৃথিবীর পথে যদি ফিরি আমি—ট্রাম বাস ধুলো দেখিবো অনেক আমি—
দেখিবো অনেকগুলো বস্তি, হাট—এঁদো গলি, ভাঙ্গা কলকী হাড়ী
মারামারি, গালাগালি, ট্যারা চোখ, পচা চিংড়ি—কত কি দেখিব নাহি লেখা
তবুও তোমার সাথে অনন্তকালেও আর হবে নাকো’ দেখা।


কাব্যগ্রন্থ - রুপসী বাংলা



মে ১২, ২০২০

অদ্ভুত আঁধার এক এসেছে এ পৃথিবীতে আজ -জীবনানন্দ দাশ


অদ্ভুত আঁধার এক এসেছে এ পৃথিবীতে আজ

জীবনানন্দ দাশ




অদ্ভুত আঁধার এক এসেছে এ-পৃথিবীতে আজ,
যারা অন্ধ সবচেয়ে বেশি আজ চোখে দ্যাখে তারা;
যাদের হৃদয়ে কোনো প্রেম নেই - প্রীতি নেই - করুণার আলোড়ন নেই
পৃথিবী অচল আজ তাদের সুপরামর্শ ছাড়া।
যাদের গভীর আস্থা আছে আজো মানুষের প্রতি
এখনো যাদের কাছে স্বাভাবিক ব'লে মনে হয়
মহত্‍‌ সত্য বা রীতি, কিংবা শিল্প অথবা সাধনা
শকুন ও শেয়ালের খাদ্য আজ তাদের হৃদয়।





মে ১২, ২০২০

আবার আসিব ফিরে কবিতা -জীবনানন্দ দাশ


আবার আসিব ফিরে

জীবনানন্দ দাশ




আবার আসিব ফিরে ধানসিঁড়িটির তীরে - এই বাংলায়
হয়তো মানুষ নয় - হয়তো বা শঙ্খচিল শালিখের বেশে;
হয়তো ভোরের কাক হয়ে এই কার্তিকের নবান্নের দেশে
কুয়াশার বুকে ভেসে একদিন আসিব এ কাঁঠাল-ছায়ায়;
হয়তো বা হাঁস হবো - কিশোরীর - ঘুঙুর রহিবে লাল পায়,
সারা দিন কেটে যাবে কলমীর গন্ধ ভরা জলে ভেসে ভেসে;
আবার আসিব আমি বাংলার নদী মাঠ ক্ষেত ভালোবেসে
জলাঙ্গীর ঢেউয়ে ভেজা বাংলার এ সবুজ করুণ ডাঙ্গায়;


হয়তো দেখিবে চেয়ে সুদর্শন উড়িতেছে সন্ধ্যার বাতাসে;
হয়তো শুনিবে এক লক্ষ্মীপেঁচা ডাকিতেছে শিমুলের ডালে;
হয়তো খইয়ের ধান ছড়াতেছে শিশু এক উঠানের ঘাসে;
রূপসার ঘোলা জলে হয়তো কিশোর এক শাদা ছেঁড়া পালে
ডিঙা বায়; - রাঙ্গা মেঘ সাঁতরায়ে অন্ধকারে আসিতেছে নীড়ে
দেখিবে ধবল বক; আমারেই পাবে তুমি ইহাদের ভীড়ে।





মে ১২, ২০২০

আমি যদি হতাম- জীবনানন্দ দাশ


আমি যদি হতাম

জীবনানন্দ দাশ



আমি যদি হতাম বনহংস;
বনহংসী হতে যদি তুমি;
কোনো এক দিগন্তের জলসিঁড়ি নদীর ধারে
ধানক্ষেতের কাছে
ছিপছিপে শরের ভিতর
এক নিরালা নীড়ে;


তাহলে আজ এই ফাল্পুনের রাতে
ঝাউয়ের শাখার পেছনে চাঁদ উঠতে দেখে
আমরা নিম্নভূমির জলের গন্ধ ছেড়ে
আকাশের রুপালি শস্যের ভিতর গা ভাসিয়ে দিতাম-
তোমার পাখনায় আমার পালক, আমার পাখনায় তোমার রক্তের স্পন্দন-
নীল আকাশে খইক্ষেতের সোনালি ফুলের মতো অজস্র তারা,
শিরীষ বনের সবুজ রোমশ নীড়ে
সোনার ডিমের মতো
ফাল্গুনের চাঁদ।
হয়তো গুলির শব্দঃ
আমাদের তির্যক গতিস্রোত,
আমাদের পাখায় পিস্‌টনের উল্লাস,
আমাদের কন্ঠে উত্তর হাওয়ার গান!


হয়তো গুলির শব্দ আবারঃ
আমাদের স্তব্ধতা,
আমাদের শান্তি।
আজকের জীবনের এই টুকরো টুকরো মৃত্যু আর থাকত না:
থাকত না আজকের জীবনের টুকরো টুকরো সাধের ব্যর্থতা ও অন্ধকার;
আমি যদি বনহংস হতাম,
বনহংসী হতে যদি তুমি;
কোনো এক দিগন্তের জলসিড়ি নদীর ধারে
ধানক্ষেতের কাছে।


মে ১২, ২০২০

অবশেষে(বিখ্যাত বাংলা কবিতা)-জীবনানন্দ দাশ


অবশেষে

জীবনানন্দ দাশ



এখানে প্রশান্ত মনে খেলা করে উঁচু উঁচু গাছ।
সবুজ পাতার ‘পরে যখন নেমেছে এসে দুপুরের সূর্যের আঁচ
নদীতে স্মরণ করে একবার পৃথিবীর সকালবেলাকে।
আবার বিকলে হলে অতিকায় হরিণের মতো শান্ত থাকে
এই সব গাছগুলো, -যেন কোনো দূর থেকে অস্পষ্ট বাাতস
বাঘের ঘ্রাণের মোত হৃদয়ে জাগায়ে যায় ত্রাস;
চেয়ে দেখ- ইহাদের পরস্পর নীলিম বিন্যাস
নড়ে উঠে ত্রস্ততায়, – আধো নীল আকাশের বুকে
হরিণের মতো দ্রুত ঠ্যাঙের তুরুকে
অন্তর্হিত হয়ে যেতে পারে তারা বটে;
একজোট হেয় কাজ করে মানুষেরা যে- রকম ভোটের ব্যালটে :
তবুও বাঘিনী হয়ে বাতাসকে আলিঙ্গন করে -
সাগরের বালি আর রাত্রির নক্ষত্রের তরে।




মে ১২, ২০২০

অনেক রাত্রিদিন(বিখ্যাত বাংলা কবিতা) -জীবনানন্দ দাশ

অনেক রাত্রিদিন

জীবনানন্দ দাশ




অনেক রাত্রিদিন ক্ষয় ক'রে ফেলে
এখন এসেছি এক উৎসের ভিতরে;
মাঠের উপরে ক্রমে ছায়া নেমে আসে,
দু-চারটে উঁচু গাছ রোদে খেলা করে।
পৃথিবী রক্তপাত অশান্তি এখন;
অর্থময়তা তবু পেতে পারে মন।


কেউ নেই - শুধু এই মননের সহায়তা আছে;
যা-কিছু বুঝেছি অনেক দিন সে-সবের নীতি
দু-চারটে বই ঠাণ্ডা সলতের আলো
নক্ষত্র ও সূর্যে আধো উজ্জ্বল প্রকৃতি
আছে তবে, পৃথিবীতে হৃদয় যা চেয়েছিলো তার
শূন্যতাকে স্নিগ্ধ ক'রে রয়েছে যুক্তির অন্তঃসার।


শরীর নির্বল হ'য়ে যেতেছে কেবলি;
ক্রমে আরো ক্ষমাহীন কঠিন সময়
মনকে নিস্তার দিলে দিতে পেরে তবু
শরীরকে ক'রে যাবে ক্ষয়;
ক্ষয়িত এ-শরীরের সঙ্গে মিলন
ভুলে মন হতে চায় সনাতন মন।


মে ১২, ২০২০

শেষ হ’ল জীবনের সব লেনদেন -জীবনানন্দ দাশ

শেষ হ’ল জীবনের সব লেনদেন

জীবনানন্দ দাশ


শেষ হ’ল জীবনের সব লেনদেন,
বনলতা সেন।
কোথায় গিয়েছ তুমি আজ এই বেলা
মাছরাঙা ভোলেনি তো দুপুরের খেলা
শালিখ করে না তার নীড় অবহেলা
উচ্ছ্বাসে নদীর ঢেউ হয়েছে সফেন,
তুমি নাই বনলতা সেন।


তোমার মতন কেউ ছিল কি কোথাও?
কেন যে সবের আগে তুমি চলে যাও।
কেন যে সবের আগে তুমি
পৃথিবীকে করে গেলে শূন্য মরুভূমি
(কেন যে সবের আগে তুমি)
ছিঁড়ে গেলে কুহকের ঝিলমিল টানা ও পোড়েন,
কবেকার বনলতা সেন।
কত যে আসবে সন্ধ্যা প্রান্তরে আকাশে,
কত যে ঘুমিয়ে রবো বস্তির পাশে,
কত যে চমকে জেগে উঠব বাতাসে
হিজল জামের
বনে থেমেছে স্টেশনে বুঝি রাত্রির ট্রেন,
নিশুথির বনলতা সেন।



রবিবার, ১০ মে, ২০২০

মে ১০, ২০২০

কুটুম্বিতা-বিচার(রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কবিতা)


কুটুম্বিতা-বিচার

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর



কেরোসিন-শিখা বলে মাটির প্রদীপে,
ভাই ব’লে ডাক যদি দেব গলা টিপে।
হেনকালে গগনেতে উঠিলেন চাঁদা—
কেরোসিন বলি উঠে, এসো মোর দাদা!


(কণিকা কাব্যগ্রন্থ)



মে ১০, ২০২০

কাগজের নৌকা(ছোটদের মজার কবিতা) -রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর


কাগজের নৌকা

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর 


ছুটি হলে রোজ ভাসাই জলে
কাগজ-নৌকাখানি।
লিখে রাখি তাতে আপনার নাম,
লিখি আমাদের বাড়ি কোন গ্রাম
বড়ো বড়ো ক'রে মোটা অক্ষরে
যতনে লাইন টানি।
যদি সে নৌকা আর-কোনো দেশে
আর-কারো হাতে পড়ে গিয়ে শেষে
আমার লিখন পড়িয়া তখন
বুঝিবে সে অনুমানি
কার কাছ হতে ভেসে এল স্রোতে
কাগজ-নৌকাখানি ।।


আমার নৌকা সাজাই যতনে
শিউলি বকুলে ভরি।
বাড়ির বাগানে গাছের তলায়
ছেয়ে থাকে ফুল সকাল বেলায়,
শিশিরের জল করে ঝলমল্‌
প্রভাতের আলো পড়ি।
সেই কুসুমের অতি ছোটো বোঝা
কোন্‌ দিক-পানে চলে যায় সোজা,
বেলাশেষে যদি পার হয়ে নদী
ঠেকে কোনোখানে যেয়ে -
প্রভাতের ফুল সাঁঝে পাবে কূল
কাগজের তরী বেয়ে ।।


আমার নৌকা ভাসাইয়া জলে
চেয়ে থাকি বসি তীরে।
ছোটো ছোটো ঢেউ উঠে আর পড়ে,
রবির কিরণে ঝিকিমিকি করে,
আকাশেতে পাখি চলে যায় ডাকি,
বায়ু বহে ধীরে ধীরে ।
গগনের তলে মেঘ ভাসে কত
আমারি সে ছোটো নৌকার মতো -
কে ভাসালে তায়, কোথা ভেসে যায়,
কোন দেশে গিয়ে লাগে।
ঐ মেঘ আর তরণী আমার
কে যাবে কাহার আগে ।।


বেলা হলে শেষে বাড়ি থেকে এসে
নিয়ে যায় মোরে টানি
আমি ঘরে ফিরি, থাকি কোনে মিশি,
যেথা কাটে দিন সেথা কাটে নিশি,
কোথা কোন্‌ গাঁয় ভেসে চলে যায়
আমার নৌকাখানি ।
কোন্‌ পথে যাবে কিছু নাই জানা,
কেহ তারে কভু নাহি করে মানা,
ধ'রে নাহি রাখে, ফিরে নাহি ডাকে -
ধায় নব নব দেশে।
কাগজের তরী, তারি 'পরে চড়ি
মন যায় ভেসে ভেসে ।।


রাত হয়ে আসে, শুই বিছানায়,
মুখ ঢাকি দুই হাতে -
চোখ বুঁজে ভাবি এমন আঁধার,
কালী দিয়ে ঢালা নদীর দুধার -
তারি মাঝখানে কোথায় কে জানে
নৌকা চলেছে রাতে।
আকাশের তারা মিটি মিটি করে,
শিয়াল ডাকিছে প্রহরে প্রহরে,
তরীখানি বুঝি ঘর খুঁজি খুঁজি
তীরে তীরে ফিরে ভাসি।
ঘুম লয়ে সাথে চড়েছে তাহাতে
ঘুম-পাড়ানিয়া মাসি ।।


(শিশু কাব্যগ্রন্থ)